Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeবাংলাফেরারী গাড়ি কোম্পানি তৈরির ইতিহাস কী? এই গাড়ি জগৎ বিখ্যাত কেন?

ফেরারী গাড়ি কোম্পানি তৈরির ইতিহাস কী? এই গাড়ি জগৎ বিখ্যাত কেন?

“ফেরারি”- নামটি শুনলেই চোখে ভাসে গতি আর সৌন্দর্যের এক চমৎকার যুগলবন্দী! গাড়ি প্রেমী মানুষের কাঙ্খিত একটি শব্দ ফেরারি । মানুষের হৃদস্পন্দন কেড়ে নেয় এর ইঞ্জিনের গর্জন আর আভিজাত্য। উনিশ শতকে গাড়ি আবিষ্কারের পর তখনকার গাড়ির জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসে ফেরারি। গাড়ির জগতে ফেরারি নামটি এতটাই উজ্জ্বল যে, প্রতিটি গাড়িপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে এর স্থান। রুচিশীলতা আর উৎকর্ষের দিক দিয়ে এই ব্র্যান্ড নিজেদের নিয়ে গেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক স্থানে। ভোক্তা সন্তুষ্টির ক্ষেত্রেও তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। একেকটি ফেরারি যেন গতি, ডিজাইন এবং বিশুদ্ধতার অপরূপ মিশেলে তৈরি। রেসিং ট্র্যাকেও কোনো তুলনা নেই তার। গাড়িপ্রেমীদের মধ্যে ফেরারিকে নিয়ে যে বিশাল মাতামাতি, তা-ই তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যথেষ্ট। সব সফল উদ্যোগের পেছনে থাকেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। মাইক্রোসফটের বিল গেটস, অ্যাপলের স্টিভ জবস, আমাজনের জেফ বেজোস তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তেমনি ফেরারি কোম্পানির সাথেও জড়িয়ে আছে এমনই একজন স্বপ্নদ্রষ্টার নাম। তিনি এনজো ফেরারি।

স্বপ্নের শুরু-

এনজো ফেরারির জন্ম ১৮৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইতালির মদেনা শহরে। এনজোর বাবা আলফ্রেডো ফেরারি ছিলেন মদেনা শহরেরই একজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও গাড়ির বিভিন্ন মেরামতেরও কাজ করতেন তিনি। ছোট ছেলে এনজো মাঝে মাঝে তার সাথে কাজ করতেন। এনজোর ড্রাইভিং এর হাতেখড়ি তার বাবা আলফ্রেডোর কাছেই। ১৯০৮ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে কার রেস ‘Circuito di Bologna’ দেখার পরই তিনি তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নেন। এরপরই একজন রেস ড্রাইভার হওয়ার জন্য তাঁর অধ্যাবসায় শুরু হয়। এরপর থেকে তার প্রতিটি দিন কাটতে থাকে কার রেসিংয়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। তিনি গাড়ির বিভিন্ন কাজ শেখার চেষ্টা করেন এবং ড্রাইভ করার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই রেস ড্রাইভার হিসেবে কাজ খুঁজতে থাকেন।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তরুণ এনজো যুদ্ধে যোগদান করেন। ইতালীয় আর্মির একজন সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। যুদ্ধ শেষে ফিরে আসেন নিজ শহরে। তার তখন একটি কাজ দরকার। কাজের জন্য তিনি আবেদন করেন তৎকালীন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ফিয়াটে। কিন্তু ফিয়াট তাকে ফিরিয়ে দেয়। ১৯১৮ সালে তিনি মিলিটারিদের পুরনো গাড়ির শ্যাসি তুরিন থেকে মিলানে নিয়ে যাওয়ার কাজ পান, যা ছিল তাঁর রেসড্রাইভার হওয়ার স্বপ্ন পুরনের পথে একটি বড় ধাপ। এখানে এসে তিনি বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ার এবং রেসড্রাইভারদের সাথে পরিচিত হন। এরপরই তিনি প্রথম রেসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান। এর আগে তিনি কিছুদিন টেস্টড্রাইভার হিসাবে ‘Costruzioni Meccaniche Nazionali’ নামের মিলানের একটি গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৯১৯ সালের ৫ অক্টোবর জীবনের প্রথম রেসে অংশ নেন তিনি। এটি ছিল পাহাড়ি রাস্তার একটি রেসিং প্রতিযোগিতা। এখানে তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে এনজোর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। তৎকালীন বিখ্যাত কোম্পানি আলফা রমেওতে রেসিং ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। সহকর্মী হিসেবে পান তখনকার নামকরা রেসিং ড্রাইভার তাজিও নুভোলারিকে।

১৯২৩ সালে এনজো ‘সারকুতো দেল সাভিও’ নামে একটি রেসে জয়ী হন যা ছিল ঐ সময়ে ইতালির সবচেয়ে কঠিন একটি রেসিং ট্র্যাক। ঐ রেসে অর্থপ্রদানকারী একজন কাউন্ট ছিলেন, নাম এনরিকো বারাকা। তিনি এনজোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছেলে ফ্র্যানসিস্কো বারাকার (যিনি ছিলেন তখনকার টপ রাঙ্ক জেট ফাইটার রেসার) জেট ফাইটার বিমানে ব্যবহৃত ঘোড়ার ছবিটি সহ একটি মেডেল উপহার দেন।

১৯২৩ সালের পর থেকে এঞ্জো বেশ কিছু বড় রেস প্রতিযোগিতায় জয়ী হন। এর মধ্যে ‘Coppa Acerbo’ ছিল অন্যতম যা তাঁকে আলফা রোমিও থেকে আরো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। ১৯৩২ সালে ছেলে দিনো-র জন্মের পর এনজো মোটর রেসিং থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং আলফার রেসিংকারের উন্নয়নে মনোযোগী হন।

স্কুদেরিয়া ফেরারি গঠন-

১৯২৯ সালে এনজো ফেরারি আলফা রমেওতে চাকরিরত অবস্থায় ‘স্কুদেরিয়া ফেরারি’ বা ‘টিম ফেরারি (Team Ferrari)’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি কার রেসিং গ্রুপ। ফ্র্যানসিস্কো বারাকার স্মরণে, এনজো বারাকার দেয়া মেডেলটিতে থাকা উদ্ধত কালো ঘোড়ার ছবিটি তাঁর রেসিং টিমের গাড়িতে ব্যবহার করেন, যা পরে বিখ্যাত কোম্পানির লোগো হিসেবে ব্যবহৃত হয়।  আলফা রমেওর নিজস্ব একটি রেসিং ডিপার্টমেন্ট থাকার পরও তারা স্কুদেরিয়াকে অনুমোদন দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্কুদেরিয়ার ড্রাইভারেরা আলফা রমেওর গাড়ি ব্যবহার করতো। স্বল্প সময়ের মধ্যে টিম ফেরারি আলফা রমেওর অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়। জার্মান রেসিং কারের যুগে তাঁর তৈরি রেসিং কারের দক্ষতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ফলে ১৯৩৩ সালে আলফা রমেও তাদের নিজস্ব রেসিং ডিভিশন বন্ধ করে দেয় এবং স্কুদেরিয়া ফেরারিকেই কোম্পানির প্রধান রেসিং বিভাগে উন্নীত করে। এমন অবস্থা চলে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। সেই বছর আলফা রমেও ‘আলফা কর্স’ নামে তাদের নিজস্ব রেসিং ডিপার্টমেন্ট পুনরুজ্জীবিত করে এবং স্কুদেরিয়া ফেরারি বন্ধ করে দেয়। এনজো আলফা কর্সের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। তবে সেখানে তিনি বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। কারণ, নিজের রেসিং গ্রুপ ভেঙে যাওয়ার দুঃখ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। দুই বছর পর ১৯৩৯ সালে এনজো আলফা রোমিও থেকে এই শর্তে পদত্যাগ করেন যে, পরবর্তী চার বছরে তিনি কোনো ধরনের রেস বা রেসিং কারে ফেরারি নাম ব্যবহার করতে পারবেন না। আলফা রমেও থেকে বের হবার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি ‘অটো এভিও কস্ত্রুজিওনি’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল রেসিং কার তৈরি করা এবং বিভিন্ন কার রেসে অংশ নেয়া। ‘AAC 815’ ছিল এনজো তথা ফেরারি কোম্পানির প্রথম তৈরি গাড়ি। তবে চার বছরের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে সেই গাড়িতে ফেরারি নামটি ব্যবহার করা যায়নি।

ফেরারি কোম্পানির যাত্রা শুরু-

১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এনজোকে তার কোম্পানির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। যুদ্ধের মধ্যেই আলফা রমেওর সাথে চার বছরের চুক্তি শেষ হয়। ফলে কোম্পানির নাম এবং নির্মিত গাড়ির নাম ফেরারি রাখার ক্ষেত্রে সকল বাঁধা দূর হয়ে যায়। ১৯৪৪ সালের দিকে মিত্র বাহিনীর বোমা হামলার শিকার হয় মারানেল্লোতে অবস্থিত ফেরারির কারখানা। তবে দ্রুতই তা পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৫ সালে ফেরারি তাদের নির্মিত V12 ইঞ্জিনের সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা পরবর্তীতে তাদের নির্মিত গাড়িগুলোর সিগনেচার ইঞ্জিনে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ফেরারি ‘Ferrari 125S’ নামের একটি গাড়ি তৈরি করে। এটি ছিল ফেরারি নাম ব্যবহার করা প্রথম গাড়ি এবং এতে V12 ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল। ঐ বছরের ১১ মে তারিখে পিয়াসেনজা রেসিং সার্কিটে ‘F125S’ অংশগ্রহণ করে। এটাই ছিল কোনো ফেরারি গাড়ির প্রথমবারের মতো রেসিংয়ে অংশ নেয়া।

(ছবিঃ- ফেরারি অটোমোবাইলের প্রথম গাড়ি Ferrari 125S.)

১৯৪৯ সালে 166 inter গাড়িটি বাজারে আসে। এটি ছিল ফেরারির প্রথম ‘জি টি’(Grand Tourer) গাড়ি যা ডিজাইন করা হয় দ্রুতগতি ও দূরপাল্লার পথে চালানোর জন্য। ফেরারি রেসিং জগতে প্রভাবশালী আলফা রোমিও এর সাথে টেক্কা দিতে নিজের টিম নিয়ে রেসে অংশগ্রহন করেন। তাঁর টিম ১৯৪৮ সালে তুরিনে প্রথম ওপেন হুইল রেসে অংশ নেয় এবং ১৯৪৯ সালে একটি ফেরারি 166 MM নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। গাড়িটি ড্রাইভ করেছিলেন লুইজি সিনেত্তি।

(ছবিঃ- ফেরারি 166 Inter)

(ছবিঃ- ফেরারি 166 Inter)

লুইজি সিনেত্তি ছিলেন একজন সফল ইতালিয়ান কার রেসার। ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত হলেও ১৯৪৬ সালে তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত ২৪ ঘন্টার ‘Le Mans’ এবং ‘Spa 24 Hours’ রেসে তিনি Ferrari 166MM মডেলের গাড়ি নিয়ে জয়লাভ করেন। এটি ছিল কোনো ফেরারি গাড়ির প্রথমবারের মতো ‘Le Mans’ এবং ‘Spa 24 Hours’ রেস জয় করার কীর্তি। ‘কারেরা প্যানামেরিকান’ রেস ছিল তার সর্বশেষ বড় ধরনের রেস জয়। ১৯৫০ সালে ফেরারি সবে চালু হওয়া ফর্মুলা ওয়ান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নেন এবং এটি একমাত্র কোম্পানি যা এই চ্যাম্পিয়নশীপের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই রেসে অংশ নিচ্ছে। ফেরারির প্রথম গ্রা প্রি জয় আসে ১৯৫১ সালে, ব্রিটিশ গ্রা প্রি মোটর রেসিং এ জোসে ফোরলান এর হাত ধরে। শোনা যায় এই রেসে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর এনজো বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলেন!

(ছবিঃ- স্কুদেরিয়া ফেরারির প্রথম গ্রা প্রি জয়)

ফেরারির প্রথম ফর্মুলা ওয়ান জয় আসে এর পরের বছরই ১৯৫২ সালে। এই রেসে আলবার্তো আসকারি T500 মডেলের গাড়িটি ড্রাইভ করেন। ১৯৫০-১৯৬৫ সালে ফেরারির সবচেয়ে বড় জয় গুলো আসে যা জনগণের কাছে এর জনপ্রিয়তা অনেক বাড়িয়ে দেয়।

ফেরারির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি-

তখন পর্যন্ত ফেরারি শুধুমাত্র রেসিং কার তৈরি করতো। পরবর্তীতে সিনেত্তি এনজো ফেরারিকে সর্বসাধারণের জন্য স্পোর্টস্‌ কার তৈরি করার প্রস্তাব দেন। শুরুতে এনজো কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। কারণ তার কোম্পানির সকল পরিকল্পনাই ছিল কার রেসকে ঘিরে এবং যেসব গাড়ি তারা বিক্রি করতো তা-ও ব্যক্তিগতভাবে অর্ডার করতে হত। তবে একসময় এনজো সিনেত্তির প্রস্তাবে রাজি হন এবং ফেরারি কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে স্পোর্টস্‌ কার তৈরি করা শুরু করে।

(ছবিঃ- লুইজি সিনেত্তি এবং এনজো ফেরারি)

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে ফেরারি কোম্পানি আমেরিকায় তাদের বাণিজ্য বিস্তারে মনস্থির করে। এ লক্ষ্যে আমেরিকান নাগরিক সিনেত্তিকে আমেরিকায় ফেরারির রপ্তানিকারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সিনেত্তিই আমেরিকার ম্যানহাটনে প্রথমবারের মতো ফেরারির শো-রুম উদ্বোধন করেন। আমেরিকাতে ফেরারি গাড়ি খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ধীরে ধীরে আমেরিকা হয়ে ওঠে ফেরারির প্রধান বাজার, যা কি না আজ পর্যন্ত বজায় আছে। আমেরিকাতে রপ্তানি শুরুর পর থেকেই ফেরারির আয় বিদ্যুৎ গতিতে বাড়তে থাকে। একইসাথে বাড়তে থাকে কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থেকে ফেরারির নাম। ফেরারিকে নিয়ে এ সময় সবার মধ্যে যে বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয় তা কখনোই কোম্পানির জন্য চাপ হয়ে আসেনি। তারা ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে গেছে অসাধারণ সব গাড়ি তৈরির মাধ্যমে। ক্রেতা সন্তুষ্টির লক্ষ্যে একের পর এক বিলাসবহুল এবং অত্যাধুনিক গাড়ি বাজারে নিয়ে এসেছে তারা। এসবের মধ্যে ছিল ক্যালিফোর্নিয়া স্পাইডার, জিটিও এবং টেস্টারোসা মডেলের গাড়িগুলো। প্রতিটি মডেলই অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬০ সালের মধ্যে ফেরারির গাড়িগুলো ট্র্যাক এবং ট্র্যাকের বাইরে রাজকীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

(ছবিঃ- GTO মডেলের একটি গাড়ি)

(ছবিঃ- Ferrari Testarossa)

১৯৬০ সালে এনজো তাঁর স্ত্রী লরাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু লরাকে অযোগ্য হিসেবে মনে করায় এনজো তাঁর নয়জন টপ ম্যানেজারকে বরখাস্ত করেন। যদিও তখন দক্ষ ও পেশাদার কর্মী পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতিতেও দারুনভাবে ঘুরে দাঁড়ান এনজো। সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাকে ‘দি গ্রেট ওয়াক আউট’ বলা হয়েছে। বেশকিছু নতুন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করেন তিনি যারা ১৯৬৪ সালে 250GTO সিরিজের প্রথম গাড়িটি তৈরি করেন। এটি পরপর তিনবার ওয়ার্ল্ড স্পোরস কার চ্যাম্পিয়নশীপ বিজয়ী হয়।

এরপর বাজারে আসে 275 সিরিজের গাড়িগুলো। এটি ছিল V12 পাওয়ারের ফ্রন্ট ইঞ্জিন গাড়ি। এছাড়াও ১৯৬৮ সালে দুইসিটের মিড ইঞ্জিনের ‘dino’ গাড়িটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। 275 সিরিজ এবং পরবর্তীতে ‘Daytona’ গাড়িগুলো বাজারে ফেরারির চাহিদা অনেক বাড়িয়ে দেয়।

(ছবিঃ- ফেরারি Daytona)

১৯৬৩ সালের দিকে ফোর্ড কোম্পানির প্রধান দ্বিতীয় হেনরি ফোর্ড, ফেরারি কোম্পানি কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি এনজো ফেরারির কাছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু এনজো সরাসরি তা নাকচ করে দেন। ফেরারি কোম্পানি কিনতে ব্যর্থ হেনরি ফোর্ড অন্যভাবে এই ব্যর্থতার প্রতিশোধ নিতে চাইলেন। তিনি ‘Le Mans’ রেসে ফেরারিকে হারানোর ব্যাপারে মনস্থির করেন। ঐ সময় ‘Le Mans’ রেসে ফেরারি ছিল এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। ১৯৬০-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত একটানা ছয়বার ফেরারি ঐ রেস জিতে আসছিল। ১৯৬৬ সালের মধ্যে ফেরারিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো গাড়ি ফোর্ডের হাতে চলে আসে। আর সেই গাড়িটি ছিল বিখ্যাত ‘Ford GT-40’। ১৯৬৬ সালের Le Mans রেসে GT-40 ফেরারির রাজত্বের অবসান ঘটায়। রেসের প্রথম তিনটি স্থানই দখল করে নেয় GT-40 এর তিনটি গাড়ি! ফেরারির অবস্থান ছিল ২৯তম। পরবর্তী তিন বছর ফোর্ডের রাজত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৯৬৬-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ঐ রেসের প্রথম স্থান অর্জন করে Ford GT-40।

(ছবিঃ- ১৯৬৬ সালের Le Mans রেসের ফিনিশ লাইন ছোঁয়ার আগে তিনটি Ford GT-40)

১৯৬৯ সালের দিকে এনজো বুঝতে পারেন যে, ফেরারির সাফল্য পুনরুদ্ধার করতে হলে এবং ফোর্ডের সাথে প্রতিযোগিতায় কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আরও বিনিয়োগ দরকার। ফলে ঐ বছর এনজো তার কোম্পানির ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেন ফিয়াটের কাছে। সেই ফিয়াট, যারা একসময় এনজোকে চাকরি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল! ফিয়াটের কাছে শেয়ার বিক্রির পর কোম্পানিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ফলে নতুন মডেলের গাড়ি তৈরির পথ সুগম হয়। এ সময় তারা তৈরি করে ‘Ferrari 312P’ মডেলের একটি রেসিং কার। কিন্তু ফেরারির দুর্ভাগ্যই বলতে হয়। কারণ ঐ বছর পোর্শা তাদের ‘Porsche 914’ মডেলের অসাধারণ একটি রেসিং কার তৈরি করে, যা ঐ বছরের ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসকার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। ফেরারিকে চতুর্থ স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরবর্তী তিন বছর রেসিং ট্র্যাকে রাজত্ব চলে পোর্শার।

(ছবিঃ- Ferrari-312P মডেলের একটি গাড়ি)

অবশেষে ফেরারির সাফল্য ধরা দেয় সত্তরের দশকে। ১৯৭৫,১৯৭৭ এবং ১৯৭৯ সালে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং সিজনের বেশ কিছু সার্কিটে প্রথম স্থান দখল করে নেয় ফেরারি। ১৯৭৩ সালে ফেরারি স্পোরস কাররেসিং থেকে অবসর নিয়ে ফর্মুলা ওয়ানে বেশি মনোযোগী হয়। ১৯৮৪ সালে কোম্পানিটি প্রথম সুপার কার তৈরি করে যার মডেল ছিল 288 GTO। এছাড়াও বেশকিছু কনসেপ্ট কার ও বাজারে আনে যার মধ্যে Mythos অন্যতম। Millechili ফেরারির সর্বশেষ কনসেপ্ট কার যা বাজারে আসে ২০১০ সালে।

(ছবিঃ- ফেরারির প্রথম সুপার-কার; F288 GTO.)

আশির দশক ছিল ফেরারির জন্য একইসাথে আনন্দের এবং কষ্টের। ১৯৮৮ সালে ফেরারির প্রতিষ্ঠাতা এনজো ফেরারি ৯০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তবে মৃত্যুর আগে তিনি কোম্পানির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি নতুন গাড়ি তৈরির অনুমোদন দিয়ে যান। আর সেই গাড়িটি ছিল ফেরারির ইতিহাসের অন্যতম সেরা গাড়ি F-40।

(ছবিঃ- F-40 মডেলের একটি গাড়ি)

বর্তমানে ফেরারী-

এনজো ফেরারির মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন কোম্পানির দীর্ঘদিনের নির্বাহী কর্মকর্তা লুকা মন্টেজেমোলো। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ফেরারি একটি বৈশ্বিক বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। বর্তমানে ফেরারির একেকটি সুপারকার লক্ষ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়। আবুধাবিতে ফেরারির একটি নিজস্ব অ্যামিউজমেন্ট পার্কও রয়েছে! ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি ফিয়াট ফেরারির ১০০% শেয়ারের মালিকানা গ্রহন করে। ২০০২ সালে এনজোর স্মরণে তাঁর নামে F60 গাড়িটি বাজারে আসে। একে ‘দি এনজো ফেরারি’ নামে ডাকা হয়। এটি একটি বারো সিলিন্ডারের মিড ইঞ্জিন স্পোরস কার। প্রথমদিকে মডেলটি শুধুমাত্র বিশ্বস্ত এবং পুরনো গ্রাহকদের কেনার সুযোগ দেয়া হতো। ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ফেরারি ড্রাইভিং ইভেন্ট’ উদযাপন করার জন্য ইংল্যান্ডের সিলভার স্টোন সার্কিট এ একটি প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ৯৬৪টি ফেরারি গাড়ি অংশ নেয় যা একটি রেকর্ড।

(ছবিঃ- দি এনজো ফেরারি)

২০১৪ সালে ব্র্যান্ড ফিন্যান্স ফেরারিকে ‘মোস্ট পাওয়ারফুল ব্র্যান্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৮ সালে ফেরারির ১৯৬৪ সালে তৈরি 250 GTO গাড়িটি ৭০ মিলিয়ন ডলার এ বিক্রি হয় যা ইতিহাসের সবচেয়ে দামি গাড়ির মর্যাদা পেয়েছে। ২০১৮ সালের শেষে ফেরারির বিক্রিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ২০৮,৯৩১ টি। সারাবিশ্বে বর্তমানে গাড়ির শোরুম রয়েছে ত্রিশটি যার মধ্যে দুইটি ফেরারির নিজস্ব এবং বাকিগুলো বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি পরিচালনা করে। রেসিং সার্কিটে ফেরারি এখনও রজত্ব করে চলেছে। এর মধ্যে ২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর ফেরারিকে নিয়ে মাইকেল শুমাখার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন। বর্তমানে ফেরারি গাড়ির যেসব মডেল বাজার কাঁপাচ্ছে তার মধ্যে Ferrari California, Ferrari 488 GTB, Ferrari 488 Spider, Ferrari 488 Pista, Ferrari 512 berlinetta উল্লেখযোগ্য।

(ছবিঃ- Ferrari 488 Pista)

(ছবিঃ- Ferrari 488 Spider)

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রেতাদের একের পর এক অসাধারণ গাড়ি উপহার দিয়ে চলেছে ফেরারি। প্রতিটি গাড়িই একেকটি বিস্ময় এবং আপন আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সর্বদা ক্রেতা সন্তুষ্টির প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া এই বিশ্বখ্যাত কোম্পানির কমার্শিয়াল এবং মার্কেটিং ডিরেক্টর এনরিকো গেলিয়েরার একটি বক্তব্য দিয়ে এই লেখাটি শেষ করা যায়। তিনি বলেছেন,

আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যান বাদে অন্য কারো, এমনকি শীর্ষস্থানীয় ম্যানেজার এবং নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও একটি ফেরারি কেনার বা পাবার অধিকার নেই। কারণ একজন ক্রেতার একটি ফেরারি পেতে ১২-১৮ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এতদিন অপেক্ষার পর তিনি যদি এসে দেখেন যে, যে গাড়ি পেতে তার এতদিন অপেক্ষা করতে হলো, সেই গাড়িই কোম্পানির কর্মকর্তারা সহজেই পেয়ে যাচ্ছে, তাহলে তার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না! তাই আমরা বছরে যতগুলো গাড়ি তৈরি করি, তার সবগুলো শুধুই ক্রেতাদের জন্য।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments